কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: মোঃ মুনজুরুল ইসলাম
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া,উজানগ্রাম, আবদালপুর, হরিনারায়ণপুর, মনোহরদিয়া, গোস্বামীদূর্গাপুর, কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর, সদকী, নন্দলালপুর, চাপড়া, যদুবয়রা, চাঁদপুর, পান্টি, চরসাদীপুরসহ অনেক গ্রামে এ বছর কলার বাম্পার ফলন হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে সরজমিনে গিয়ে কলা চাষীদের সাথে সাক্ষাৎ করা হয়। এইসব এলাকায় কলা চাষে কৃষকদের ভাগ্য বদলে যাচ্ছে। জমিতে বসেই কলার ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে সোনালী হাসি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূল থাকায় কলা গাছে ব্যাপক কলা ধরেছে। তবে মৌসুমের শুরুতে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কলাগুলোর বৃদ্ধি কম হয়েছে। এরপরও কলার ভাল ফলন পেতে কলা চাষীরা দিন রাত পরিচর্যা করে যাচ্ছে। কিছু কিছু কলা গাছে আগাম কলা পাকতে শুরু করেছে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রচুরকলা রাজধানীসহ বিভিন্ন বড় জেলায় সরবরাহ করা হবে বলে আশা করছেন চাষীরা। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় উপজেলার বিস্তৃর্ণ জমিতে এবার কলা চাষে বাম্পার ফলন হয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত ফসল চাষে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান না হওয়ায় তারা এই সব ফসলের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন অধিক লাভজনক ফসল কলা চাষ। বিভিন্ন জাতের কলার মধ্যে রয়েছে জয়েন্টগর্ভানর, সাগর ও সর্বি কলা। তরে সিংহভাগ জমিতে চাষ করা হয়েছে সর্বি কলা। ধান, পাট ও আখসহ প্রচলিত অন্যান্য ফসলের তুলনাই কলা চাষে শ্রম ব্যয় হয় কম, বিক্রি করতেও ঝামেলা নেই বাগান থেকেই বিক্রি হয়। অন্যদিকে কলার বাজারে সহজে ধস নামে না। চর অঞ্চলের এসব জমিতে অন্যকোন ফসল ভাল না হওয়ায় পুষ্টিকর ফল কলার চাষ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কলাচাষের পাশাপশি এখানকার কৃষকরা সাথী ফসল হিসেবে ওল এবং পটল চাষ করে বাড়তি আয় করছে। একই সময়ে একাধিক ফসল চাষের ফলে কৃষকরা বেশী লাভবান হচ্ছেন । ফলে এখানকার কৃষকরা জমির জন্য ক্ষতিকর তামাক ও ভুট্টা চাষের প্রতি দিন দিন আগ্রহ হারাচ্ছে। স্বল্প খরচ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় কলাচাষ লাভজনক হওয়ায় বেড়েছে কলার আবাদ। উৎপাদিত মেহেরসাগর জাতের কলার চাহিদা ও খ্যাতি এখন দেশজুড়ে। বাণিজ্যিকভাবে মেহেরসাগর জাতের কলা চাষের সঙ্গে জড়িয়ে সচ্ছলতা ফিরেছে কয়েক হাজার কৃষক পরিবারে। মাটি ও আবহাওয়া মেহেরসাগর জাতের কলা চাষের উপযোগী হওয়ায় একবার চারা রোপণ করে বছরে তিনবার কলা বিক্রি করতে পেরে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। তারা বলছেন, একবার চারা রোপণ করে তিনবার কলার ফলন পাওয়া যায়। খরচ কম অথচ লাভ বেশি, তাই চাষিরা কলাচাষে ঝুঁকে পড়েছেন। কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের কলা চাষি স্বপন বিশ্বাস জানান, স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে ৪০০ জয়েন্ট গভর্নর কলার চারা আমদানি করে এক বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম। সেই এক বিঘা কলায় অল্প টাকা খরচ করে ভালো লাভ হয়। পরে গেল দুই বছর থেকে মেহেরসাগর জাতের কলার আবাদ করি। এ জাতের কলা বড়, সুস্বাদু এবং রং সুন্দর হওয়ায় দেশের সব জেলাতেই কলার চাহিদা অনেক বেশি। দুই বিঘা জমিতে মেহেরসাগর জাতের কলা লাগিয়েছিলাম। প্রথমবারেই খরচের টাকা বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে দ্বিগুণ। ওই জমি থেকে এখনও দুইবার কলা পাওয়া যাবে।কৃষক বজলুর রহমান বলেন, বর্তমানে এ জেলা থেকে প্রতিদিন ট্রাকভর্তি হয়ে কলা দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। আমরা প্রতিদিনই গাছ থেকে কলা কেটে কাঁদি হিসেবে কলা বিক্রি করছি। প্রতি কাঁদি কলা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা থেকে সাড়ে ৪০০ টাকায়।নন্দলালপুর ইউনিয়নের চাষি হেলাল সেখ, তিনি এক বিঘা জমিতে মেহেরসাগর কলার আবাদ করেছেন। কোনো রাসায়নিক সার না দিয়ে পাঁচ ট্রলি গোবর সার দিয়েছেন। তিনি জানান, প্রতিবছরের পৌষ মাসে কলার চারা রোপণ করার উপযুক্ত সময়। মাঘ মাসে এই চারা জমিতে লেগে গেলে একটি সেচ দিতে হয়। মাটি ঝরঝরে হলে জমি কুপিয়ে দিতে হবে। এরপর গাছের গোড়া থেকে বের হওয়া চারা কেটে দিতে হবে। এভাবে একটু যত্ন আর গবাদিপশুর আক্রমণ ও কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেই হাসি ফুটবে চাষির মুখে। তার হিসাবে, এক বিঘা জমিতে কলার চাষ করতে প্রথম বছরে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিবিঘা জমিতে প্রতিবছর ৪০০ থেকে ৪৫০ কাঁদি কলা পাওয়া যায়। যা খেত থেকে পাইকারি মূল্যে বিক্রি করলে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এভাবে দুই বছরে মোট তিনবার কলা পাওয়া যাবে। পরের দুইবার সার-বিষ ও পানি সেচ বাবদ সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা করে খরচ করলে যথেষ্ট। কলা চাষ লাভজনক হওয়ায় একই এলাকার চাষি আব্দুল মাজেদ জানান, আমাদের এলাকার হোসেন আলী তিন বিঘা, ইয়ারুল ইসলাম পাঁচ বিঘা, আহাজদ্দির ছয় বিঘা, বান্টু মিয়া চার বিঘা, আক্তারুল ইসলাম দুই বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছেন। আগামী মৌসুমে তিনি নিজেও কয়েক বিঘা জমিতে কলা চাষ করবেন। চরসাদীপুর ইউনিয়নের কলা চাষী লুৎফর রহমান বলেন আমাদের ইউনিয়নে কলা চাষ করে অভাবনিয় সফলতা পেয়েছেন প্রায় শতাধিক চাষি। গ্রামে যখন কোন ফসল ভাল হচ্ছিল না তখন সাহস করে কয়েকজন চাষি কলা চাষ করে বাম্পার ফলন ফলিয়ে এলাকার মানুষ কে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। চরসাদীপুরে উৎপাদিত কলা রফতানি হচ্ছে বিভিন্ন জেলায়। কলা হচ্ছে গ্রাম বাংলার বারোমাসি ফল। ছোট বড় সব বয়সের প্রিয় ফল কলা। রমজান মাসে মুড়ি, বুট আর বুন্দিয়ার সাথে কলা না থাকলে যেন ইফতারে অপূর্ণতা থেকে যায়। এক সময় প্রায় বাড়ীতে মালভোগ, মনুয়া, চিনি চাম্পা, আটিয়া সহ বিভিন্ন জাতের কলার গাছ লাগাতো সেগুলো এখন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়ার পথে। বর্তমানে অধিক ফলন আর লাভের আশায় সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে সাগর কলা। কলা বাণিজ্যিক ভাবে চাষ হচ্ছে কুষ্টিয়া জেলার বেশ কিছু গ্রামে। বেশী লাভজনক হওয়ায় এখন উপজেলার অনেক কৃষক অন্যান্য ফসলের চাষ বাদ দিয়ে কলা চাষের দিকে ঝুকে পড়ছে। সফল কলা চাষী মান্নান সরকার বলেন, অন্যান্য ফসলের চেয়ে কলা চাষে লাভ বেশি এবং খরচ কম। জৈব সার ব্যবহার করার কারণে এখানে ফলন ভালো হয়। আমি ৫ বছর যাবত কলাচাষ করছি। এ বছর ১০ বিঘা জমিতে সাগর কলা, অমৃত সাগর, মেহর সাগরসহ বিভিন জাতের চারা রোপণ করেছিলাম। প্রতি বিঘা জমিতে ৩০০-৪০০ চারা রোপণ করা যায়। বছর খানেকের মধ্যেই রোপণকৃত গাছ থেকে কলা পাওয়া যায়। আমার কলাচাষে সফলতা দেখে এলাকার কৃষকরা কলা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।